বাংলাদেশ থেকে গত অর্থবছরে ১৮ কোটি ৮৭ লাখ ডলার বা এক হাজার ৯৮২ কোটি টাকার (প্রতি ডলার ১০৫ টাকা) ওষুধ রপ্তানি হয়েছে। বিশ্বের ১৪০টি দেশে এ ওষুধ রপ্তানি হলেও সবচেয়ে বড় চালানটি গেছে পাশের দেশ মিয়ানমারে। দেশটিতে গত অর্থবছরে দুই কোটি ৭৬ লাখ ডলার বা ২৮৯ কোটি টাকার ওষুধ রপ্তানি হয়েছে, যা মোট ওষুধ রপ্তানির প্রায় ১৫ শতাংশ। যদিও ওষুধ খাতে প্রায় পুরোপুরি আমদানিনির্ভর মিয়ানমারের মোট চাহিদার মাত্র ৫ শতাংশের দখল বাংলাদেশের। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মিয়ানমারের ওষুধ খাতে বাংলাদেশের হিস্যা বাড়ানোর খুব ভালো সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
রোহিঙ্গা ইস্যু, জান্তা সরকারের আমলে সীমান্ত এলাকায় বিদ্রোহীদের দমন-পীড়নের মধ্যেও আগের অর্থবছরের তুলনায় (দুই কোটি ২৪ লাখ ডলার) মিয়ানমারে ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে ২৪ শতাংশের বেশি। কিন্তু মিয়ানমারের প্রতিবছর ওষুধের যে চাহিদা, সে তুলনায় বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র ৫ শতাংশ। জাতিসংঘের কমট্রেড ডাটা অনুযায়ী, ২০২১ সালে মিয়ানমার প্রায় ৫৫ কোটি ডলারের ওষুধ আমদানি করে। এর মধ্যে ভারত থেকে আমদানি করেছে ২৯ কোটি ৮৫ লাখ ডলার, যা মোট আমদানির প্রায় ৫৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে গত অর্থবছরে ৩৪ আইটেমের পণ্য রপ্তানি হয়েছে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে। এ পণ্য থেকে আয় হয়েছে তিন কোটি ৮৮ লাখ ডলার। এর মধ্যে শুধু ওষুধ রপ্তানি হয়েছে দুই কোটি ৭৬ লাখ ডলারের, যা মিয়ানমারে মোট রপ্তানির প্রায় ৭১ শতাংশ।
আবার ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ১৪০টি দেশে মোট ১৮ কোটি ৮৭ লাখ ডলারের ওষুধ রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ওষুধ রপ্তানি হয়েছে মিয়ানমারে। ওষুধ রপ্তানিতে এর পরই আছে শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও যুক্তরাষ্ট্র। দেশগুলোতে গত অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি হয়েছে যথাক্রমে দুই কোটি ৩২ লাখ, দুই কোটি ২৬ লাখ ও এক কোটি ৩৪ লাখ ডলারের। আগের অর্থবছরেও বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রপ্তানির শীর্ষ দেশ ছিল মিয়ানমার। এ সময় দুই কোটি ২২ লাখ ডলারের ওষুধ রপ্তানি হয় দেশটিতে।
তবে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে নিজেদের হিস্যা বাড়াচ্ছে। রপ্তানিমুখী অনেক ওষুধ কম্পানি এখন মিয়ানমারে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করছে। মিয়ানমারে ওষুধ রপ্তানির তালিকায় নতুন করে নাম ওঠাতে যাচ্ছে চট্টগ্রামের এলবিয়ন গ্রুপ। বন্দরনগরের একমাত্র ওষুধ রপ্তানিকারক কম্পানিটি আগামী মাসে ওমিপ্রাজল গ্রুপের ২০ ফুটের এক কনটেইনার ওষুধ মিয়ানমারে রপ্তানি করতে যাচ্ছে, যার মূল্য প্রায় ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। তবে এটা শুরু। এরই মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপের ৪০টি ওষুধ নিবন্ধনের জন্য মিয়ানমার ঔষধ প্রশাসনের কাছে আবেদন করা হয়েছে বলে জানালেন এলবিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান রাইসুল উদ্দিন সৈকত। এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আগামী মাসে ট্রায়াল বেসিস ওষুধের একটি চালান মিয়ানমারে যাবে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর হয়ে সরাসরি মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন বন্দরে যাবে কনটেইনারটি। গত জুন মাসে আরো ৪০টি ওষুধের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। অনুমোদন পেতে বছরখানেক লেগে যাবে।’ অনুমোদন পেয়ে গেলে বাংলাদেশি ওষুধের সম্ভাবনাময় বাজারটিতে এলবিয়ন ভবিষ্যতে বড় পরিসরে রপ্তানি করবে বলে আশা প্রকাশ করেন এই ব্যবসায়ী। তবে এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের জান্তা সরকার গত এপ্রিল মাসে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে যে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে, সেটা কিছুটা বাধা সৃষ্টি করছে।
তবে এ জন্য সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ-মিয়ানমার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট এস এম নুরুল হক। ২০১৪ সালে মিয়ানমারের ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল, যেখানে বেশির ভাগই ছিলেন চিকিৎসক কিংবা ফার্মাসি রিলেটেড, তাদের বাংলাদেশ সফরে এনে বেশ কয়েকটি ওষুধ কারখানা ভিজিট করানো হয়েছিল। দলটি মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পর সেখানে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানিতে একটা ভালো প্রভাব পড়েছিল। সেই সফরের অন্যতম উদ্যোক্তা এস এম নুরুল হক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২০১০ সালে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ওষুধের চাহিদা ছিল প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার। সেখানে ২০২১ সালে এসে আমরা প্রতিবেশী দেশটিতে ওষুধ রপ্তানি করেছি মাত্র ২৭ থেকে ২৮ মিলিয়ন ডলার, যা নিতান্তই কম। সরকারের উচিত সেখানকার প্রথম সারির বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, যারা মূলত ওষুধ প্রেসক্রাইব করবেন তাদের বাংলাদেশে এনে এখানকার একাধিক কমপ্লায়েন্স ওষুধ কারখানা পরিদর্শন করানো। ওষুধ উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়া তাদের সামনে তুলে ধরা। তাহলে অবশ্যই এর একটা পজিটিভ ইমপ্যাক্ট পড়বে।’
বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনে মিয়ানমার জান্তার জারি করা বিধি-নিষেধ বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য খুব বেশি সমস্যা সৃষ্টি করবে না বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা। কারণ বাংলাদেশ মিয়ানমারসহ আটটি দেশ এশিয়ান ক্লিয়ারেন্স এজেন্সি বা আকুর সদস্য হওয়ায় নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন সম্ভব। সুত্র: কালের কন্ঠ
পাঠকের মতামত